বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৫১ অপরাহ্ন
ইমরান আল মাহমুদ, উখিয়া : উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মহসিন।
এ ঘটনায় আহতের সংখ্যা উল্লেখ না করলেও খুবই কম সংখ্যক এবং আহতদের কেউ শংকাজনক অবস্থায় নেই বলেও জানিয়েছেন তিনি।
নিহত ১১ জনের মধ্যে ৭ জনের পরিচয় পাওয়া গেলেও অন্য ৪ জনের নিশ্চিত হয়নি। এছাড়া পরিচয় পাওয়াদের মধ্যে ৩ শিশুসহ ৫ জন পুরুষ ও ২ জন নারী।
তবে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, আগুন লাগার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১৫ জন, আহত হয়েছে ৫৬০ জন এবং নিখোঁজ রয়েছে ৪০০ জন।
এদিকে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনায় ১১ জনের মৃত্যুর তথ্য জানালেও আহত ৫০০ জন এবং নিখোঁজ আনুমানিক ৪০০ জন বলে জানিয়েছে।
এছাড়া সরকারি প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষ থেকে ঘরহারা মানুষের সংখ্যা আনুমানিক ৪৫ হাজার বলা হলেও পরিবারের সংখ্যা নিয়ে রয়েছে ভিন্ন তথ্য।
এতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ৯ হাজার ৩০০ টি, ১৩৬ টি লার্নিং সেন্টার, ২ টি হাসপাতাল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ইউএনএইচসিআর ও আই্ওএম দাবি করেছে ১০ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মহসিন উখিয়ার বালুখালীতে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।
পরে বিকাল ৫ টায় কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১১ জন; ঘটনায় খবই কম সংখ্যক মানুষ আহত হয়েছেন। আর যারা আহত হয়েছে কেউ শংকাজনক অবস্থায়ও নেই। ”
এসময় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব জানান, আগুন লাগার ঘটনায় চারটি ক্যাম্পের ৯ হাজার ৩০০ পরিবারের আনুমানিক ৪৫ হাজার মানুষ, ১৩৬ টি লার্নিং সেন্টার ও ২ টি হাসপাতাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া স্থানীয় বাসিন্দাদের বসতঘর সহ দুই শতাধিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রেস ব্রিফিংয়ে কেউ নিখোঁজ রয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে সাংবাদিকদের মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ঘটনার তদন্তে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তের পর এ ব্যাপারে জানা যাবে। কেউ কেউ হয়তো আশপাশের ক্যাম্পে আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতদের ঘরে আশ্রয় নিয়ে থাকতে পারে। আগামী দু’য়েক দিনের মধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব হবে।
অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে তিনদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এ সচিব।
কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যবাসন কমিশনার শাহ মো, রেজওয়ান হায়াত’কে। এতে সদস্য করা হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী বিষয়ক সেলের প্রধান (যুগ্ম-সচিব) মো. হাসান সারওয়ার, কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের একজন প্রতিনিধি, জেলা পুলিশ সুপারের একজন প্রতিনিধি, কক্সবাজারের ১৪ আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক (এসপি), বালুখালীর ৮-ডব্লিউ ক্যাম্পের ইনচাজঅ, কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক, অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. খলিলুর রহমান খান।
গঠিত তদন্ত কমিটিকে অগ্নিকান্ডের কারণ উদঘাটন এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নির্ধারণ করে প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানান মোহাম্মদ মহসিন।
তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা ও স্থানীয় বাসিন্দারা যাতে খাদ্য সংকটে না পড়ে সেই জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নগদ ১০ লাখ টাকা এবং ৫০ মেট্রিক টন চাল তাৎক্ষণিক বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ৩ হাজার ৮০০ রোহিঙ্গা পরিবারকে অন্য ক্যাম্পে আশ্রয়ের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া ঘটনাস্থলে ৮০০ টি অস্থায়ী তাবু স্থাপন করে ক্ষতিগ্রস্তদের আপাতত আশ্রয়েরও ব্যবস্থা নেয়া হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জানিয়েছেন, অগ্নিকান্ডে আগুণের সূত্রপাতের কারণ এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে এ নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর প্রকৃত কারণ জানানো সম্ভব হবে।
সোমবার বিকাল ৪ টায় উখিয়ার বালুখালী ৮-ডব্লিউ ক্যাম্প থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা পাশের ৯, ১০ ও ১১ নম্বর ক্যাম্পেও ছড়িয়ে পড়ে বলে জানান অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. সামছু-দৌজা নয়ন।
তিনি বলেন, “ ক্যাম্পের বসত ঘরগুলো ঝুপড়ির মত লাগোয়া হওয়ায় এবং সে সময় বাতাসের গতি বেশী থাকায় আগুন দ্রুত ছড়ায়। আগুন লাগার সাথে সাথে স্বেচ্ছাসেবক কর্মিরাসহ স্থানীয়রা আগুন নেভানোর চেষ্টা চালায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের কমিরাও আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে যোগ দেয়। ”
কক্সবাজারের ১৪ আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক (এসপি) আতিকুর রহমান জানিয়েছেন, আগুন লাগার খবরে ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, এপিবিএন ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকরা ৫ ঘন্টার বেশী সময় ধরে চেষ্টার সোমবার রাত সোয়া ৯ টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাম্পগুলোর কোন কোন অংশে সারারাতই ধোঁয়া উড়তে দেখেছেন।
এর আগে মঙ্গলবার সকালে কক্সবাজার ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের জেষ্ঠ্য স্টেশন অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, “ ভোররাত পর্যন্ত সাতজন রোহিঙ্গার মৃতদেহ উদ্ধার করে এপিবিএন এর কাছে হস্তান্তর করেছি। তাদের মধ্যে ২ জন শিশু, ২ জন নারী ও ৩ জন পুরুষ রয়েছে। ”
এদিকে সোমবার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লাগার ঘটনার পরপরই উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের বালুখালীতে আবুল কাশেম চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ে এনজিওদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক খোলা হয় একটি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র।
এতে দায়িত্ব পালনকারি বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সহকারি স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. রঞ্জু মিয়া বলেন, “ সোমবার বিকাল থেকে সামান্য ও গুরুতর আহত অন্তত ২ সহস্রাধিক রোহিঙ্গা স্বাস্থ্য কেন্দ্রটিতে ভর্তি হয়েছেন। পরে অধিকাংশ জনই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে ফিরে গেলেও গুরুতর আহত অল্প কয়েকজনকে অন্যত্রে প্রেরণ করা হয়েছে। ”
মঙ্গলবার বিকালে প্রেস ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মহসিন অগ্নিকান্ডের ঘটনায় আপাতত নিখোঁজের কোন তথ্য নেই জানিয়েছেন।
তবে এ নিয়ে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ক্ষতিগ্রস্ত বলিবাজার এলাকায় অস্থায়ীভাবে স্থাপিত এনজিও সংস্থা ব্র্যাকের চাইল্ড প্রটেকশন প্রকল্পের সিএসএফ কর্মকর্তা মো. সোহেল রানা জানিয়েছেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিখোঁজ ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া শিশুদের সন্ধানে সংস্থাটির ৩০০ জন স্বেচ্ছাসেবী কর্মি কাজ করছে। মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত সংস্থাটির কাছে দেড়-শতাধিক নিখোঁজ থাকার তথ্য তারা পেয়েছে। এদের মধ্যে ৮ জনকে উদ্ধার করে পরিবারের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
তিনি বলেন, “ এখনো অনেক শিশু নিখোঁজ তথ্য সংস্থাটির কাছে আসা অব্যাহত রয়েছে। নিখোঁজের এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। ”
এদিকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকান্ডের ঘটনার সার্বিক চিত্র নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা-ইউএনএইচসিআর এর সহকারি জনসংযোগ কর্মকর্তা মোস্তফা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসাইন স্বাক্ষরিত একটি এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম এর জনসংযোগ কর্মকর্তা তারেক মাহমুদ স্বাক্ষরিত আরেকটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি কক্সবাজারের স্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো হয়।
এতে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাসহ ক্ষয়ক্ষতির যে তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে তাতে সাংবাদিকদের কাছে প্রেস ব্রিফিংয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের দেয়া তথ্যের মিল নেই।
ইউএনএইচসিআর এর পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১৫, আহত হয়েছে ৫৬০ জন এবং নিখোঁজ রয়েছে ৪ শতাধিক। আর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার এবং মানুষের সংখ্যা ৪৫ হাজার।
এছাড়া আইওএম এর পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ক্যাম্পে আগুন লাগার ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ১১ জন, আহত হয়েছে ৫০০ জন এবং নিখোঁজ রয়েছে ৪০০ জন। এছাড়া ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার প্রায় ১০ হাজার এবং মানুষের সংখ্যা ৪৫ হাজার।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply